অধ্যাপক ড. নূরুল ইসলাম, পিপিএন বাংলা:
ভারত উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িকতার নিজস্ব সংজ্ঞা আছে। সংজ্ঞাটা এরূপ, বিভেদকামী, অপর সম্প্রদায়ের প্রতি অসহিষ্ণু ও সহিংস মতাদর্শকে সাম্প্রদায়িকতা বলা হয়। ইউরোপ ও আমেরিকায় সাধারণ জনমানুষের জন্য কল্যাণকর কাজ করাকে সাম্প্রদায়িকতা বলা হয়। বস্তুতঃ ঐ সব দেশের জাতিবিদ্ধেষ এদেশের সাম্প্রদায়িকতা। অপর সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে ঘৃণা পোষণকারী, অসহিষ্ণু ও সহিংস মতাদর্শকে সাম্প্রদায়িকতা বলে।
সত্য বলতে কি, সাম্প্রদায়িকতা এদেশের জন্য এক মহাভিশাপ। এই অভিশাপের শিকার কোটি কোটি মানুষ। গত একশো বছরে কত লক্ষ মানুষ এই অভিশাপের শিকার হয়েছে! নিহত ও আহত হয়েছে! এবং কত মানুষ গৃহহীন হয়েছে! নির্দিষ্ট ও সঠিক পরিসংখ্যান দেওয়া প্রায় অসম্ভব! তবে, এনিয়ে কম গবেষণা হয়নি। এপর্যন্ত কয়েক শত সন্দর্ভ রচিত হয়েছে। সাম্প্রদায়িকতার উৎস, বিকাশ ও ভয়াবহতা বিষয়ে বিজ্ঞান ভিত্তিক আলোচনা হয়েছে। এবিষয়ে আমার প্রণীত গ্রন্থ ‘Communalism and Counter-communalisn in India’, pp. 420. Price 400/- Ananda Prakashan. Kolkata. বহু গবেষকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।
সাম্প্রদায়িকতা ও জাতিবিদ্ধেষ আধুনিক বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশের এক ভয়াবহ সমস্যা। কিন্তু ভারত উপমহাদেশে এ সমস্যার তীব্রতা ভয়ানক। ইতিমধ্যে সাম্প্রদায়িকতা এদেশকে তিন খন্ডে বিভক্ত করেছে। এই বিভক্তি ও বিভাজন সমস্যার সমাধান করতে সক্ষম হয়নি। বরং কোটি কোটি মানুষের জীবনে চিরস্থায়ী নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি করেছে।
ভারত উপমহাদেশে মূলতঃ তিনটি ধর্ম সম্প্রদায় এই ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত ও সংঘর্ষে লিপ্ত। এই তিনটি শ্রেণী যথাক্রমে হিন্দু, মুসলিম ও শিখ।
স্বাধীনোত্তর ভারতে সাম্প্রদায়িকতার চরিত্র ব্রিটিশ ভারত থেকে ভিন্ন। সে সময় ছিল প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতা। আর এখন সাম্প্রদায়িকতা বলে কিছু নেই। আছে শুধু মাত্র উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদ। অসহিষ্ণু ফ্যাসিবাদ। রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় আধিপত্যকামী হিন্দুত্বের বিস্তার। রাষ্ট্র শক্তি দখলের তীব্র প্রচেষ্টা। ফ্যাসিবাদের বিচিত্র সংস্করণ। বিজেপি- আর এস এস হিন্দুত্ব। কংগ্রেসী হিন্দুত্ব। বামপন্থী হিন্দুত্ব। দলিত হিন্দুত্ব। হিন্দু আধিপত্য প্রতিষ্ঠার ভিন্ন ভিন্ন পন্থা। উগ্রতা ও তীব্রতার মধ্যে ভিন্নতা।
নিরঙ্কুশ হিন্দু আধিপত্য প্রতিষ্ঠার পন্থা ও পদ্ধতির দীর্ঘ পরীক্ষা ও বাস্তবায়ন চলছে। নিরবিচ্ছিন্নভাবে। সুসংহতভাবে। পরিকল্পিতভাবে।
পরিকল্পিত দাঙ্গা ও গণহত্যার মাধ্যমে মুসলিমদের সন্ত্রস্ত করা। তাদের ব্যবসায়িক পরিকাঠামো ধ্বংস করে দেওলিয়া করে দেওয়া। রাষ্ট্রের নীতি নির্ণয় থেকে তাদের ব্রাত্য রাখা। সরকারি আমলাতন্র থেকে বঞ্চিত রাখা। ডি ফ্যাক্টো, দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক রূপে তাদের বিবেচনা করা। এসব উগ্র হিন্দু ফ্যাসিবাদীদের সুসংহত রণকৌশলের অংশ।
দীর্ঘ আক্রান্ত, অবদমিত, বঞ্চিত ও দূর্বল একটি জনগোষ্ঠী ভারতীয় মুসলিম সম্প্রদায়। তারা হিন্দুদের অবদমিত করবে। ক্ষমতাহীন করবে। ধ্বংস করবে। এই তত্ত্ব কোনো উন্মাদও বিশ্বাস করবেনা। যদি তারা সংগঠিত,সবল ও সক্রিয় হতো। আগ্রাসী হতো। সাম্প্রদায়িক হতো। সন্ত্রাসী হতো। তাহলে, হিন্দু সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের জবাব দিতো। মব লিঞ্চিং এর জবাব দিতো গুপ্ত হত্যার মাধ্যমে।
তারা এদেশে স্থিতিশীলতা চায়। শান্তি চায়। সম্প্রীতি চায়। তারা সহাবস্থানে বিশ্বাসী। নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করুন। এদেশে কারা স্থিতিশীলতা নষ্ট করছে? কারা অশান্তি সৃষ্টি করছে? কারা সম্প্রীতি চায়না। কারা সহাবস্থান চায়না। কারা ঘৃণা ও বিদ্ধেষ পোষণ করে? কারা ঔদ্ধত্য ও আভিজাত্য প্রদর্শন করে? কারা অস্পৃশ্যতায় বিশ্বাসী? উত্তর দিন। সততার সঙ্গে। নিরপেক্ষভাবে।
বন্ধু, এই বিভেদ ও বিভাজনের রাজনীতি সম্প্রীতি ও সংহতির শত্রু। শান্তি ও সমৃদ্ধির জন্য বিপজ্জনক। বৃহত্তম গণতন্ত্রের গর্ব ও আস্ফালন দেখে পৃথিবী হাসবে। যথার্থ গণতন্ত্রের অনুশীলন একমাত্র সমাধান।